সুনামগঞ্জ - খাদিমনগর - সিলেট - রাতারগুল ভ্রমণ কাহিনী - আবুল কালাম
This page was last updated on 16-Nov-2022 12:37pm , By Raihan Opu Bangla
রিহলাহ বাংলাদেশের উদ্যোগে মোটর বাইকে দ্বিতীয় অভিযাত্রা। সুনামগঞ্জের উদ্দেশে। ৭ জুন সকাল ৭টা কুড়ি মিনিটের মধ্যে আমাদের উপস্থিত থাকার কথা শনির আখড়ায়। আমি আমার Suzuki Gixxer 150 নিয়ে সময়মত পৌছে গেলাম। ৪ অভিযাত্রীর দুজন যথাসময়ে উপস্থিত হলেও বাকি দু’জন এসে পৌঁছেন কিছুক্ষণ পর। সবাই মোটামুটি লংরাইডে অভ্যস্থ। আমার হালকা-পাতলা একসিডেন্টের কলঙ্ক থাকলেও অন্যরা রাইডিং এ বেশ অভিজ্ঞ। আজ আমি আপনাদের সাথে সুনামগঞ্জ - খাদিমনগর - সিলেট - রাতারগুল ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে কিছু কথা শেয়ার করব।
সুনামগঞ্জ - খাদিমনগর - সিলেট - রাতারগুল ভ্রমণ কাহিনী
![](https://adserver.bikebd.com/storage/app/files/1/2024/7.%20July%202024/300-x-250%20yamaha%20july%202024.webp)
যাত্রালগ্নে আমার Suzuki Gixxer 150 মিটারবক্স। রানিং ৯৯১৭ কিলোমিটার। সময় সকাল ৭:১৯ শনির আখড়া থেকে সম্মিলিত যাত্রার প্রারম্ভে আমাদের নির্দিষ্ট কিছু গাইডলাইন ফলো করতে হয়। প্রথমেই কোষাধ্যক্ষ নির্বাচন। এই পদে গরিষ্ট ভোটে নির্বাচিত হন Nurul Islam সাহেব। পদটিতে আমারও যে আগ্রহ কম ছিলো—তা নয়; করোনার এই অনটনকালে দু-চার মুদ্রা নয়ছয় করার প্ররোচনা শয়তান বারবারই দিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় সেই আশার গুড়ে পরলো বালি। সামনে চলি।
সিদ্ধান্ত হলো ভৈরব পর্যন্ত সামনে থাকবে Ridwan Hasan ভাইয়ের Lifan KPR 165। লিভো নিয়ে মাঝে থাকবে Kazi Jubair Mahmud আর নুরুল ইসলাম। Suzuki Gixxer 150 নিয়ে আমি থাকবো পেছনে। সেই মতে রান। সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে গাউসিয়ায় নাশতার জন্য ছোট্ট বিরতি নেয়া হয়। বাইক জার্নিতে এই এক সুবিধা। যখন যেখানে যেভাবে ইচ্ছা, আপনি উপভোগ করতে পারেন। পানাহার, বিশ্রাম, রাইড, ইবরত - ইচ্ছে মতো করা যায়। Saifullah Al Jahid বলেছেন, “জীবনকে পরিপূর্ণ উপভোগের মাধ্যম হচ্ছে দুঃখ, আর সুখ হচ্ছে জীবনকে না বুঝা।”
![](https://adserver.bikebd.com/storage/app/files/1/2024/7.%20July%202024/suzuki%20300-X-250%20july%202024.webp)
তবে জীবনকে বুঝার, উপভোগ করার এক অবিকল্প উপাদান যে রিহলাহ (ভ্রমণ), তা তিনি কেন যে উল্লেখ করলেন না, বোধগম্য নয়। মূলত এমন বোধ ও মনন যারা লালন করেন, একমাত্র তাদের কাছেই রিহলাহ সমাদৃত। ভ্রমণ আনন্দের। ভৈরবের কাছাকাছি এলাকায়। বাইক সফরের অন্য ফিলিংস নাশতা সেরে আবার রাইড শুরু। ঘণ্টাখানেক পর বিরতি নিই। অল্প সময়ে সুনির্মল প্রকৃতির রস আস্বাদন।
চারদিকে সবুজ ফসলের বিস্তীর্ণ জমি। হাইওয়ের পাশেই একটুখানি ঝোঁপ। বসে আছে দুটি পাখির ছানা। উপরে বিদ্যুতের তারে বসে পাহারা দিচ্ছে তাদের মা। যুবাইর যখন ছানা দুটো নিয়ে আদর দিচ্ছিলো, কিচিরমিচির রবে আশপাশ তখন মুখর। দেখছি, তাদের মা ব্যাকুলচিত্তে ধেয়ে আসছে। ঠোকর খেয়ে এক পর্যায়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো যুবাইর।
![](https://adserver.bikebd.com/storage/app/files/1/2023/October%202023/kixx%20in%20article%206th%20para%20october%202023.webp)
এভাবে পদে পদে সে আমাদের বিনোদনের যোগান দিয়ে যাচ্ছিলো। আর তাকে খুনসুটি দিতে মোটেও ভুলছিলেন না নুরুল ইসলাম সাহেব। ওরা শালা-দুলাভাই বলে কথা! উভয়ের সফর সরঞ্জাম নুরুল ইসলামের কাঁধে। কেউই বুঝতে চাইলো না তার কষ্ট। এই কষ্টের মাঝে বাড়তি মাত্রা দিয়ে দিলাম আমি। এবার Suzuki Gixxer 150 রাইড করবেন তিনি। আমি বসবো যুবাইরের পিলিয়ন হিসেবে।
সুন্দর, মনোরম ও স্নিগ্ধ প্রকৃতির পরশ পেতে কার না মন চায়! ইতোপূর্বে যতবার সিলেট বিভাগে সফর হয়েছে, সবই ছিলো মাইক্রো বা বাসযোগে। রেজা হাসান ভাইদের নরসিংদী, Babor ভাইদের কিশোরগঞ্জ, মাহমূদ জা'ফরদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং Amin Iqbal ভাইদের হবিগঞ্জ যে এতো প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে টইটম্বুর— চেয়ার কোচের আরাম কেদারায় বসে কি তা আঁচ করা সম্ভব!
বাড়তি অভিজ্ঞতা নেওয়ার লক্ষ্যে এবার আমরা হাইওয়ের একটু পর পর গ্রামীণ মেঠোপথে ঢু মারতে থাকি। জানা কথা, রাস্তার পাশের পরিবেশ আর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের পরিবেশ এক নয়। ভেতরের মানুষেরা কেমন আছেন, কী করছেন, কীভাবে চলছেন, ভাষা ও কালচারাল বৈশিষ্ট্য কী—এসবের খুঁটিনাটি আমরা সামান্য হলেও জানতে পারলাম। বাইক ট্যুরে স্বাধীনভাবে ভ্রমণের এই এক সুফল।
অদেখা হাওর এবং গোসলের হাপিত্যেশ হাসলে হবে না। অধিক হাসি স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে বাইক ট্যুরও স্বস্তিকর নয়। সুতরাং ধীর, তবে ক্ষিপ্র গতিতে আমাদের পৌঁছতে হবে সুনামগঞ্জ। সেখানে আমাদের মেজবান মুশতাক আহমাদ। গত দু’দিন থেকে তাকে বিরক্ত করে আসছি। ফোন-ম্যাসেঞ্জারে বিভিন্ন নির্দেশনা আদান-প্রদান করছি।
আগেই বলেছি, বাইক ট্যুরে দল বেঁধে ভ্রমণে যে অনুভূতি কাজ করে, একাকী বা ফরমাল জার্নিতে তা সম্ভব নয়। হবিগঞ্জের মাধবপুর পেরোতেই দেখি, সড়কের দু’পাশ জলে থৈথৈ। বৃষ্টি-বন্যার ফলে এমন দশা, নাকি হাওর! শুনেছি, সুনামগঞ্জ হাওরের দেশ। তবে কি হবিগঞ্জেও হাওর আছে! থাকলেও থাকতে পারে। সমস্যা নেই। সমস্যা আমাদের গোসলের। ঠিক দুপুরে রোদের তাপে শরীরজুড়ে উত্তাপ। এছাড়া ধুলোবালিও কম পড়েনি গায়ে।
সুতরাং গোসল সারতে হবে আগে। গোসলের চিন্তায় প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার রাইডরত অবস্থায় ডানে-বাঁয়ে পরিষ্কার পানির একখান পুকুর খুঁজেছি। কিন্তু, মনমতো পেলাম না। পুকুর থাকলেও ভালো ঘাট নেই। ঘাট থাকলে দেখা যায় পানি ঘোলাটে। হঠাৎ হঠাৎ ভালো দুয়েকটা পেলেও আবার সঙ্গী অভিযাত্রীদের দেখা যায় অনেক দূর সামনে চলে গেছেন। এভাবে, বাহুবলের একটু আগে (কী যেন নাম জায়গাটার) হাইওয়ে এড়িয়ে ঢুকে পড়ি এক প্রত্যন্ত গ্রামে। চারদিকে কৃষকদের কর্মব্যস্ততা। ধান মাড়াই শেষে খড় শুকাতে দেয়া পথ বেয়ে এগিয়ে যাই মাইল চারেক। আর লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে থাকি, এখানে কি ভালো পুকুর আছে? উত্তরঃ নাই। অনেক দূরে থাকতে পারে। যেতে যেতে বহুদূরে পেয়ে গেলাম পুকুর একখান।
সবাই মিলে গোসল সারলাম। পানাহার সারলাম মাঝপথের একটি সাদামাটা পেটচুক্তি হোটেলে। হোটেলটা দেখতে খুব বেশি ভালো না কিন্তু খাবার অসাধারণ। আলহামদুলিল্লাহ। তাজপুর পর্যন্ত খুব দ্রুত চলে গেলাম, রাস্তা ভালো হলে যা হয় আর কি। এরপর শুরু হয়ে গেলো রাইডিং এর পরীক্ষা, মানে সেই জঘন্য রাস্তা। সামনের দিকে যতো এগিয়ে যাচ্ছি ততোই রাস্তা খারাপ হচ্ছে। রাস্তার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সড়ক ব্যবহার না করায় উত্তম।
বাইকের প্রচুর ক্ষতি হবে সাথে দূর্ঘটনাও ঘটতে পারে। যাই হোক, বের যেহেতু হলাম শেষটাও দেখে নেয়া যাক। প্রতি মূহুর্তে মনে মনে ভাবতে লাগলাম, এই রাস্তাগুলো দিয়ে যে বাইকার ভাইয়েরা প্রতিদিন চলাচল করে তাদের না জানি কী অবস্থা হয়। বাইকের গতি ২৫-৩০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা একটু ভালো রাস্তা পেলেই ৫০-৫৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা কিন্তু এই গতি মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। এভাবেই ঝাঁকুনি খেতে খেতে পৌঁছলাম সিলেট শহরে।
একজন ভালো মানুষের সুসান্নিধ্য এখানে আমাদের কাছে সংবাদ আসে, সুনামগঞ্জের যেসব স্থানে আমাদের যাওয়ার কথা, সেখানকার পথ বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছে; যেখানে বাইক নিয়ে যাওয়া দুষ্কর। এছাড়া ‘করোনা’র বৈরি মৌসুমটাতে রাতযাপনের কটেজ বা হোটেলও বন্ধ। পড়ে যাই দুশ্চিন্তায়। তবে আমাদের মেজবান মোশতাক ভাই অল্পক্ষণের মধ্যেই বিকল্প পন্থা বের করেন। তার নির্দেশনায় আমরা ঠাঁই নিই সিলেটের শাহপরান আবাসিকস্থ Lutfur Rahman Muhammad ভাইয়ের বিলাসবহুল বাসভবনে।
পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের দেখলে মনটা ভালো হয়ে যায়। যাদের কথা শুনলে শীতল হয়ে যায় হৃদকমল। যাদের সাথে চললে গর্বিত মনে হয় নিজেকে। যাদের স্নেহ-ভালোবাসা পেলে সুদূর প্রসারিত লাগে জীবন-নাটাই। মাকতাবাতুস সীরাহ’র কর্ণধার লুতফুর রহমান ভাই এমনই একজন মানুষ। মেখল ও দারুল উলুম হাটহাজারী পড়ুয়া বিজ্ঞ এই আলিম একজন সফল মুদাররদিস এবং তাজির। পড়াশোনার হাতেখড়ি যার আরব আমিরাতে এবং যিনি আরবি ভাষায় উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছেন শায়খ সফিউল্লাহ ফুয়াদ সাহেবের কাছ থেকে, তার আরবি ভাষাদক্ষতা সহজেই অনুমেয়।
ঘণ্টা বিশেক তার সান্নিধ্যে থেকে যা অনুমিত হলোঃ তিনি উদার, বিনয়ী, সহানুভূতিশীল, বন্ধুবাৎস্যল, নিরহঙ্কারি এবং অমায়িক। উচ্চশিক্ষা ও উচ্চবংশজাত ধারা তাকে এসব মহান গুনাবলীতে বিভূষিত করেছে। আলিম ও অতিথিদের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য তিনি যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তার প্রমাণ পেলাম প্রতিটি মুহূর্তে। অল্প সময়ের অবগতিতে এমন রাজকীয় পানাহার ব্যবস্থা সত্যিই আমাদের বিস্মিত করে তুলেছে; লজ্জিতও। লজ্জার বিষয়টা অন্য জায়গায়। সিলেটে বিকেল ৫টার পর যে লকডাইন এত কড়াকড়ি—আগে তা আঁচ করা যায়নি।
সন্ধ্যার পর শাহপরান এলাকার কোনো ফাস্টফুড বা কনফেকশনারি-জাতীয় দোকান খোলা পাইনি। ফলে ইউসুফ বিন লুতফ’র জন্য একটা চিপস নেওয়ারও সৌভাগ্য হলো না। এমন বেহায়া আগন্তুক পৃথিবীর কোথাও কখনো গত হয়েছে কিনা, খতিয়ে দেখার কম্ম। যাক, ‘টিম রিহলাহ’ নির্লজ্জ হতে পারি, কিন্তু আমরা তো পেয়ে গেছি এমন এক বন্ধু—যার অনুপম আতিথেয়তা, উদার সৌন্দর্য্য, মহানুভব সমতা, স্বকীয়তাময় সম্প্রীতি, উচ্ছ্বাসময় জাগড়ন, বন্ধুময় ঐক্য, ব্যক্তিত্বময় সমোঝতা, মিল্লাতে ইবরাহিমি চেতনা, বিশুদ্ধ ইলমি ধ্যানধারণা ও মানবিক মূল্যবোধের বহুমুখী সমন্বয়ের গঠিত একটি অনবদ্য বিস্ময়।
এমন মানুষের সুকোমল সান্নিধ্য কেবল ইমরান - Ishaq দাদাদের ভাগ্যেই জুটবে, এ কেমন স্বৈরাচারি কারবার! সফরের চিন্তায় আগের রাতে বাসায় ভালো ঘুম হয়নি। লুতফুর রহমান ভাইদের বাসায় তাই রাত এগারোটার আগেই চোখজুড়ে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। সকালে জেগে দেখি ভালো ঘুমের পাশাপাশি ভালো বৃষ্টিও হয়েছে। বৃষ্টিস্নাত আশু পথের দুর্গমতায় কপালে আবার পড়ে উদ্বেগের রেখা। লুতফুর ভাইয়ে অনুসন্ধানী চোখ তা এড়ায়নি। হয়তো এজন্য তিনি এমন কিছু জায়গায় আমাদের নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, যেখানে গেলে উড়ে যাবে সব উদ্বেগ। খুলে যাবে সমুদয় হতাশার জট।
খাদিমনগরের বিমুগ্ধ খাদিম যেই ভাবনা, সেই কাজ। আমরা চললাম খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে। সোনালি রোদে ঝকমক করছে চারদিক। দৃষ্টি আকাশের দিকে উঠতেই মনটা আনন্দে ভরে গেল। কী অপূর্ব নীল আকাশ তার সাথে সাদা মেঘ থাকায় তার সৌন্দর্য আর দ্বিগুণ বেড়েছে। অপূর্ব তার রূপ। সৌন্দর্য অতুলনীয়। আকাশের মধ্যে দুই-একটা পাখি উড়ে উড়ে খেলা করছে। খাদিমনগর যত দেখছি আমি তত মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। যত ভাবছি আমি প্রকৃতির মাঝে যেন মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছি। কী সুন্দর আল্লাহর সৃষ্টি! কী অপূর্ব তাঁর মহিমা! যত দেখছি তত আর দেখার পিপাসা বেড়ে যাচ্ছে।
এই পিপাসা বাড়তে থাকবে; কারণ এই পিপাসা যে শেষ হবার নয়! বাংলাদেশে যে কয়টি সংরক্ষিত বনাঞ্চল আছে তার মধ্যে খাদিমনগর নবীনতম। আাঁকাবাঁকা পাহাড়ি মেঠোপথ। দু’ধারে সুন্দর চা বাগান। চা বাগানের পর প্রাকৃতিক বনের হাতছানি। মূল সড়ক থেকে উত্তরের দিকে পাকা, কাঁচা ও ইট বিছানো পাঁচ কিমি পথ পেরুনোর পর খাদিমনগর রেইনফরেস্টের শুরু।
পূর্বে ছড়াগাঙ্গ ও হাবিবনগর, পশ্চিমে বরজান ও কালাগুল, উত্তরে গুলনি, দক্ষিনে খাদিমনগর এই ছয়টি চা বাগানের মাঝখানে ১৬৭৩ একর পাহাড় ও প্রাকৃতিক বনের সমন্বয়ে গড়ে উঠা এই রেইনফরেস্টটি জাতীয় উদ্যান বলে সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে। ইন্টারনেট থেকে জানলাম বাংলাদেশে যে কয়টি সংরক্ষিত বনাঞ্চল আছে তার মধ্যে খাদিমনগর নবীনতম। চা বাগান, পাহাড় আর বনভূমির অপূর্ব সৌন্দর্যের মেলবন্ধন এই খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান।
চা বাগান, পাহাড় আর বনভূমির অপূর্ব সৌন্দর্যের মেলবন্ধন এই খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানঃ আমাদের দুর্ভাগ্য; করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সতর্কতার কারণে খাদিমনগর বনের গহীনে যাওয়া নিষিদ্ধ। অন্যথায় মানচিত্রে দেয়া ট্রেইল নেয়ার ইচ্ছে ছিলো ভীষণ। ধীরলয়ে বাইক রাইড করছি আর অবগাতন করছি অসংখ্য গাছের সারির সৌন্দর্য। অর্জুন, শিমুল, চম্পা, সেগুন, গর্জন, মেহগনি, চন্দন, জারুল, চাপালিশ, বহেরা, আমলকি, হরতকি, সুপারি, ট্রি ফার্ন, একাশিয়াসহ অসংখ্য গাছ দেখে মুগ্ধ হলাম। খাদিমনগর এ দেখলাম- চির সবুজ এই বন দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ, লতাগুল্ম, পাখি আর বন্য প্রাণীদের অভয়াশ্রম।
দেখিনি; তবে শুনেছি এ বনে আরো আছে বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী, উভচর, সরীসৃপ প্রাণী এবং পাখি। এসব স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুখপোড়া হনুমান, বানর, বনবিড়াল, ভাল্লুক, মায়া হরিণ, খাটাশ, সজারু, সাদা বুক কাঠবিড়ালি, খরগোশ, বাদুর ইত্যাদি। সরীসৃপের মধ্যে আছে বিভিন্ন জাতের সাপ, অজগর, গুই সাপ, বেজি ইত্যাদি।
এছাড়া নানান পাখ-পাখালির কলকাকলিতে মুখরিত খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান। ঠিক যেন প্রকৃতির গানে মেতে থাকে এ বনের পুরোটা। সবাই বাইকে একটু পর পর ব্রেক কষে দাঁড়াই। এতো সুন্দর প্রকৃতি! বিস্মিত যুবাইর - সুর করে গান গাইছে সে। খুশিতে আত্মহারা রিদওয়ান ভাই - তার সুনির্মল হাসি সেই তথ্য জানাচ্ছে। বিমুগ্ধ নুরুল ইসলাম - তিনি স্থির ও অস্থির চিত্রে ধারণ করে রাখছেন এসব বর্ণিল স্মৃতি। সবাই বাইকে একটু পর পর ব্রেক কষে দাঁড়াই। এতো সুন্দর খাদিমনগর এর প্রকৃতি! বিস্মিত যুবাইর—সুর করে গান গাইছে সে। খুশিতে আত্মহারা রিদওয়ান ভাই — তার সুনির্মল হাসি সেই তথ্য জানাচ্ছে। বিমুগ্ধ নুরুল ইসলাম—তিনি স্থির ও অস্থির চিত্রে ধারণ করে রাখছেন এসব বর্ণিল স্মৃতি।
সুনশান নির্জনতা, দূরে কোথাও অপরিচিত পাখির ডাক, গহীন বনে দীর্ঘ শালগাছের মগডালে দুষ্টু কাঠঠোকরা পাখিটি তার লম্বা চঞ্চু দিয়ে গাছের ডালে অবিরাম আঘাত করে চলছে। হঠাৎ আগমন টের পেয়ে পাখিটি পালকের ঝাপটায় নীরবতা ভেঙ্গে দিয়ে হারিয়ে গেল পথ থেকে দূরে। ঝরা পাতাগুলো যেন রাস্তাকে সাজিয়ে রেখেছে তার বেদনায়। বনবিড়াল আর ঘুঘু সতর্ক পা ফেলে নিরাপদ দূরত্বে এদিক-সেদিক করছিলো। মাতাল করা বাতাসের হিল্লোলে বৃক্ষরাজির সবুজ পাতা আনন্দে যখন তখন নেচে ওঠে। মন কি আর সয়! যুবাইর তো বলেই ফেললো, মন ভালো করার জন্য পৃথিবী অন্যতম সেরা স্থান এই বনাঞ্চল। একই মন্তব্য এখানকার নানা প্রজাতির জীবজন্তু ও সরীসৃপ প্রাণীগুলোর বেলায়ও। যদিও আমি এগুলোর দেখা তেমন একটা পাইনি।
দারাবাজার মাদরাসায়ঃ মহান আল্লাহর অপরূপ এই মহিমান্বিত ধরার সৃজিত প্রতিটি সৃজন তুলনাহীন। এই ধরণীর যে প্রান্তরেই নয়নের দীপ্ত রশ্মি নিক্ষেপ করো না কেনো আস্বাদন বলে কোনো প্রান্ত থেকেই সেই রশ্মি ফিরে আসবে না! অপরূপ লীলায় মুগ্ধ হয়ে সে হয়তো আর ফিরে আসতে চাইবে না! কারণ, যে প্রান্তে পৌঁছাবে সে প্রান্তেই রয়েছে সৃষ্টির মুগ্ধতা। সৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে সে ব্যাকুল হয়ে পড়বে স্রষ্টার সৃষ্টির প্রেমে। মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন মহিমান্বিত এই ধরণীকে মুগ্ধতার ছোঁয়ায় প্রভাবিত করে ত্রিভুবনে পাঠিয়েছেন অসংখ্য মহা মানবগণ।
যাদের পরিশ্রমের প্রতিদানে মহিমান্বিত রূপ পায় সুন্দর এই মনোরম ধরণী। এমনই এক মহিমান্বিত দীনি প্রতিষ্ঠান দারা বাজার মাদরাসা। লুতফুর রহমান ভাই জানালেন, রেইন ফরেস্টের সামনে দিয়ে উত্তর দিকে যে রাস্তা চলে গেছে, সে দিক দিয়ে এগিয়ে গেলে এয়ারপোর্ট সড়কে উঠা যায়। এই দিক দিয়ে রাতারগুল জলাবন যাওয়া সহজ। এর আগে চলুন দারাবাজার মাদরাসায় যাওয়া যাক। এখানে তিনি গত বছর শিক্ষকতা করেছেন। নির্দেশনা মতো, আবার শুরু হলো আমাদের পথচলা। একটু এগোতেই আমাদের পাশের ঝোপঝাড়ে নড়াচড়া করছে কি যেন একটা। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাদের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল একটা বনমোরগ। বনের ভিতর একটি ছোট্ট ছড়া চোখে পড়লো যা আমাদের বেশ কয়েকবার পাড় হতে হয়েছিল। এখানে মুখ-হাত ধুয়ে নিলাম। ঘড়িতে সময় এগারোটা। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। দারা বাজার নেমে নাশতাটা সেরে নিলাম।
বাজারটি মাদরাসারই অংশ। বিশাল আয়তনের মাদরাসা। সুন্দর, সুনির্মল, সাজানো-গোছানো ছিমছাম পরিবেশ। অসংখ্য গাছ-গাছালির সমারোহ। প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার কেবল তেজপাতাই বিক্রি করা হয়। আনারস ওদা লেবুসহ নানা প্রজাতির শাক-সবজির ফলন দৃষ্টি কাড়বে সবার। আমরা মাদরাসার আশপাশে অনেকদূর হেঁটে বেড়ালাম। কিছু অংশে রয়েছে জোঁকের উপদ্রব। আমরাও বেশ কয়েকবার এদের আক্রমণের শিকার হয়েছি। এছাড়াও দেখলাম বিভিন্ন প্রকারের দেশীয় কবুতর ও মোরগ। বিশাল কয়েকটি পুকুর রয়েছে মাদরাসা।
গোসলের এক সুবর্ণ সুযোগ আমাদের সামনে। কালক্ষেপন না করে পুকুরে গোসলের নিজস্ব নিয়মে একটা লুঙ্গি ও গামছাকে পাড়ে ঘাসের ওপর এবং সাবানটা ঘাটের কাছে থুয়ে আমি প্রথমে পানিতে ডান পা বাড়ালাম। বাম পা নামানোর আগেই নুরুল ইসলাম, রিদওয়ান ও যুবাইর ঝাঁপ দিল পুকুরে। কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ হাঁটু মাজন করছে, কেউ কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে, কেউ ডুব দিচ্ছে, কুলকুচি করছে, কেউ-বা পা দিয়ে তল খোঁজার চেষ্টারত, কেউ তালুতে পানি তুলে ছুড়ছে ওপরে; প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভঙ্গিতে। বিশাল আয়তনের মাদরাসা। সুন্দর, সুনির্মল, সাজানো-গোছানো ছিমছাম পরিবেশ। অসংখ্য গাছ-গাছালির সমারোহ।
রাতারগুলঃ বাংলার অ্যামাজন দীর্ঘ সময় কেটে গেছে গোসলে। মাদরাসার এক কর্মচারী আমাদের জন্য কাঁঠাল-মুড়ি পরিবেশন করলেন। আমরা এবার ছুটলাম রাতারগুলের উদ্দেশে। দেশের একমাত্র স্বীকৃত সোয়াম্প ফরেষ্ট বা জলার বন রাতারগুলের মোটরঘাট বাজারে চলে এলাম। বাইকের এখন আর কাজ নেই। নিতে হবে নৌকা। দেখা যাচ্ছে ‘জলার বন’ রাতারগুল যা বাংলার অ্যামাজন নামে পরিচিত।
দুর্ভাগ্যক্রমে, আমার যাওয়া হয়নি। সফরসঙ্গীরা গিয়েছেন। তারা জানালেন : অনিন্দ্য সুন্দর বিশাল এ বনের গাছ-গাছালির বেশিরভাগ অংশই বছরে চার থেকে সাত মাস থাকে পানির নিচে। মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের পানি সহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে বন বিভাগ। বিশাল এ বনে রয়েছে জলসহিষ্ণু প্রায় ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ। বড়ই অদ্ভুত এই জলের রাজ্য। কোনো গাছের হাঁটু পর্যন্ত ডুবে আছে পানিতে। একটু ছোট যেগুলো, সেগুলো আবার শরীরের অর্ধেকই ডুবিয়ে আছে জলে।
কোথাও চোখে পড়বে মাছ ধরার জাল পেতেছে জেলেরা। ঘন হয়ে জন্মানো গাছপালার কারণে কেমন অন্ধকার লাগে পুরো বনটা। চারিদিকে দিনের বেলাতেই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, স্রোতের কল কল শব্দ, হটাৎ পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ, পানির ভিতরে ঘাটি গেড়ে থাকা বিশাল বিশাল গাছ, ওয়াচ টাওয়ার হতে চারপাশের ভিউ। সর্বোপরি আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য! রাতারগুলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লেখায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
এই বনের সুধা নিতে হলে যেতে হবে সেখানে। জঙ্গলের একেবারে শুরুর দিকটায় মুতার বন। এর বেশির ভাগই জলে ডুবে থাকে বর্ষায়। এর পরেই শুরু আসল বন। যতই গহীনে যাওয়া যাবে ততই গাছের ঘনত্ব বাড়তে থাকবে। অনেক জায়গাতেই সূর্যের আলো পৌঁছায় না। দুই-একদিন বৃষ্টি না হলে পানি এত বেশি স্বচ্ছ হয় যে, বনের সবুজ প্রতিবিম্বকে মনে হয় বনের নিচে আরেকটি বন। আমাদের টিম রিহলাহ আধা ঘণ্টার ভাড়া নৌকায় রাতারগুল ঘুরে ফিরে এসেছে। এবার ফেরার পালা।
ভিন্নরূপী সিলেটঃ সিলেট অনেকদিক থেকেই দেশের শীর্ষস্থানীয়। দেশের সিংহভাগ চা উৎপাদন হয় এই বিভাগে। দেশের সবচেয়ে বেশি এবং সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র এখানে, দেশের একমাত্র তেলেরক্ষেত্রেরও খোঁজ পাওয়া গিয়েছে সিলেটে। এরসাথে যদি “ডিজিটাল সিলেট সিট” প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে যায় তাহলে দেশের অন্যতম সেরা এলাকা হয়ে উঠবে এটি। আর এসব উন্নয়নের সাথে হাতে হাত ধরে আসবে সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকার রিয়েল এস্টেটের উন্নয়ন তা বলাই যায়। বিমানবন্দর সড়ক হয়ে পৌঁছলাম সিলেট শহরে। ঘড়িতে সময় তখন ৩টার বেশি। খেতে হবে। কিন্তু পানসি, পাঁচভাইসহ নগরীর সবক’টি রেস্টুরেন্ট বন্ধ দেখতে পেয়ে মনটা বিষণ্ন হয়ে উঠলো। যুবাইর ফোন দিলো নাওয়াজ মারজানকে। তার নির্দেশনা মতে জিন্দাবাজারস্থ ক্যাফে নুরজাহানে সারলাম মধ্যাহ্নভোজ।
এর আগে-পরে দেখলাম মজার কিছু বিচিত্র দৃশ্য। ভিন্ন ধরনের একটি শহর মনে হলো এটা। অসংখ্য চা-বাগান, ওলি আউলিয়ার মাজার আর মন ভুলানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্য বিখ্যাত এ শহরটি। এছাড়া এ অঞ্চলের বিশাল এক জনগোষ্ঠী যুক্তরাজ্যের লন্ডন প্রবাসী বলেও দেশে সিলেটের অনেক সুনাম আছে। এছাড়া, ডিজিটাল স্মার্ট প্রকল্পের অধীনে সিলেটই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রথম ঝুলে থাকা তার আর বৈদ্যুতিক খুঁটিবিহীন শহর। দরগা গেইট এলাকার সড়কে দেখলাম না তারের জঞ্জাল ও বিদ্যুতের খুঁটি। ফলে পুরো এলাকাটি পেয়েছে একটি ভিন্নরূপ। কড়া রোদে ‘সেইরকম’ জ্যামে আটকে পড়লাম বাইকে।
এত জ্যাম জীবনে দেখিনি। ঢাকার জ্যাম একমুখী। কিন্তু সিলেটে দ্বিমুখী যানজটে নাকাল অবস্থা। তার ওপর তীব্র রোদে নাভিশ্বাস। এরই মাঝে সিএনজি একটিতে শুনলাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সতর্কতা নিয়ে মাইকিং হচ্ছে : ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন!’ এই সামাজিক জাতিকে কিছুতেই যেন ‘অসামাজিক’ বানানো যাচ্ছে না! লুতফুর রহমান ও নাওয়াজ মারজান সাহেব থেকে বিদায় নিয়ে এবার আমরা চললাম মৌলভিবাজারের কমলগঞ্জের উদ্দেশে। (চলবে)
লিখেছেনঃ আবুল কালাম
আপনিও আমাদেরকে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠাতে পারেন। আমাদের ব্লগের মাধ্যেম আপনার বাইকের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা সকলের সাথে শেয়ার করুন! আপনি বাংলা বা ইংরেজি, যেকোন ভাষাতেই আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ লিখতে পারবেন। মালিকানা রিভিউ কিভাবে লিখবেন তা জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন এবং তারপরে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠিয়ে দিন articles.bikebd@gmail.com – এই ইমেইল এড্রেসে।